বজ্রপাত
এই প্রাকৃতিক দুর্যোগ রোধে বাস্তব পদক্ষেপ তেমন নেই।

হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলার সাহাব উদ্দিন ও তার ছোট ভাই মনির উদ্দিন আষাঢ় মাসে আমনের বীজতলা তৈরির জন্য বাড়ির পাশের একটি ক্ষেতে কাজ করছিলেন। বিকেল প্রায় শেষ, কাজও প্রায় সমাপ্ত, ঠিক তখনই আকাশ কালো মেঘে ঢেকে যায় এবং বিদ্যুৎ চমকাতে শুরু করে। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির সাথে বজ্রপাতও শুরু হয়।
সাহাব (২৫) এবং মনির (২২) ক্ষেতে কাজ শেষে খড়কি গ্রামের দিকে রওনা দিয়েও ঘরে ফিরতে পারেননি। পথে বজ্রপাতে গুরুতর আহত হন তারা। মাধবপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে চিকিৎসক দুই ভাইকেই মৃত ঘোষণা করেন। মুহূর্তের মধ্যেই একটি পরিবার তাদের দুই সদস্যকে হারিয়ে ফেলে, অথচ তাদের এই মৃত্যুর জন্য কোনো দোষ ছিল না।
সাহাব ও মনিরের মরদেহ আনতে গিয়ে তাদের স্বজনরা জানতে পারেন, একই সময় পাশের বহরা ইউনিয়নের দলগাঁও গ্রামের শফিক মিয়া (৫৫) বজ্রপাতে মারা গেছেন। তিনিও একজন কৃষক এবং ঘটনার সময় ক্ষেতে কাজ করছিলেন।
২১ সেপ্টেম্বর সিলেটের জৈন্তাপুর, কানাইঘাট, গোয়াইনঘাট ও কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় এক বিকালে বজ্রপাতে ছয়জনের মৃত্যু হয়। তারা সবাই গ্রামীণ দরিদ্র মানুষ, কেউ ক্ষেতে কাজ করছিলেন, কেউবা মাছ ধরতে গিয়েছিলেন। এক সপ্তাহের মাথায় ২৯ সেপ্টেম্বর সিলেট, সুনামগঞ্জ ও ছাতকে আবারও ছয়জন বজ্রপাতে প্রাণ হারান।
উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা হঠাৎ বেড়ে যাওয়ায় এখন বৃষ্টি হলেই কৃষক ও দিনমজুরদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, প্রতিবছর দেশে বজ্রপাতে আড়াই থেকে তিনশ মানুষ মারা যান, যার ৯৩ শতাংশই গ্রামাঞ্চলে এবং ৮৬ শতাংশ উন্মুক্ত স্থানে বজ্রপাতে মারা যান।
<দেশের ১৫টি বজ্রপাত হটস্পটের মধ্যে হবিগঞ্জ, সিলেট, সুনামগঞ্জসহ অন্যান্য উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জেলা রয়েছে, যেখানে খোলা হাওরাঞ্চল বজ্রপাতের ঝুঁকি বাড়ায়। ২০১৬ সালে বজ্রপাতকে ‘জাতীয় দুর্যোগ’ ঘোষণা করা হয়। চলতি বছর প্রথম আট মাসে বজ্রপাতে ২৯৭ জনের মৃত্যু হয়েছে, যার মধ্যে ৪৮.৮২ শতাংশ কৃষিকাজে নিযুক্ত ছিলেন।
আবহাওয়াবিদদের মতে, কিউমুলোনিম্বাস মেঘ তৈরি হলে বজ্রঝড় হয়। গরম আবহাওয়া দ্রুত উপরে উঠে গেলে আর্দ্র বায়ুর সংস্পর্শে এসে বজ্রমেঘ তৈরি হয়। সিলেট অঞ্চলে মৌসুমি বায়ু মেঘালয়ের পাহাড়ে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে সংঘর্ষের ফলে ‘সাংঘর্ষিক বৃষ্টি’ হয়, যা বজ্রপাতের ঝুঁকি বাড়ায়।
বজ্রপাত থেকে বাঁচার উপায় হিসেবে বিজ্ঞানীরা ভবনগুলোতে লাইটনিং অ্যারেস্টার ও সার্জ প্রোটেকশন ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছেন। যদিও সরকার বজ্রপাত নিরোধে তালগাছ লাগানোর প্রকল্প নিয়েছিল, তবে তা তেমন কার্যকর হয়নি।
বজ্রপাত থেকে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কিছু সাধারণ সতর্কতা ও ব্যবস্থা অনুসরণ করা উচিত, যা জীবন রক্ষা করতে সহায়ক হতে পারে:
১. খোলা জায়গায় থাকলে করণীয়:
- উঁচু স্থান থেকে দূরে থাকুন: বজ্রপাত সাধারণত উঁচু স্থানগুলোতে পতিত হয়, তাই পাহাড়, বড় গাছ বা বৈদ্যুতিক খুঁটির নিচে আশ্রয় নেওয়া থেকে বিরত থাকুন।
- খোলা মাঠ বা হাওরে থাকলে দ্রুত আশ্রয় নিন: বজ্রপাতের সময় খোলা জায়গায় থাকা অত্যন্ত বিপজ্জনক। কাছাকাছি কোনো পাকা ভবন বা গাড়ির মধ্যে আশ্রয় নিন।
- জলাশয় এড়িয়ে চলুন: নদী, পুকুর, হ্রদ বা হাওরের পাশে থাকলে বজ্রপাতের সময় দূরে সরে যান, কারণ পানি বিদ্যুৎ পরিবাহি।
২. ঘরে থাকলে করণীয়:
- বাড়ির ভেতরে থাকুন: বজ্রপাত শুরু হলে ঘরের বাইরে বের হওয়া এড়িয়ে চলুন।ইলেকট্রিক ডিভাইস থেকে দূরে থাকুন: টিভি, ফ্রিজ, কম্পিউটারসহ যেকোনো ইলেকট্রিক ডিভাইস এবং বৈদ্যুতিক সংযোগ থেকে দূরে থাকুন।
- জানালা ও দরজা বন্ধ রাখুন: বজ্রপাতের সময় বাতাস চলাচল কমাতে জানালা ও দরজা বন্ধ রাখুন।
৩. বজ্রপাত প্রতিরোধক ব্যবস্থা:
- লাইটনিং অ্যারেস্টার ব্যবহার: বাড়ি বা বড় ভবনের ছাদে বজ্র নিরোধক দণ্ড (লাইটনিং অ্যারেস্টার) স্থাপন করুন। এটি বজ্রপাতের বিদ্যুৎকে মাটিতে সুরক্ষিতভাবে নেমে যেতে সাহায্য করে।
- সার্জ প্রোটেকশন ডিভাইস: বাসা-বাড়ির বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম রক্ষার জন্য সার্জ প্রোটেকশন ডিভাইস ব্যবহার করা যেতে পারে, যা অতিরিক্ত ভোল্টেজ থেকে ডিভাইসগুলোকে সুরক্ষা দেয়।
৪. বজ্রপাতের সময় কোনো গাড়িতে থাকলে:
- গাড়ির ভেতর থাকুন: বজ্রপাতের সময় গাড়ি একটি নিরাপদ আশ্রয় হতে পারে, তবে ধাতব অংশ স্পর্শ করবেন না।
৫. জনসচেতনতা ও পরিকল্পনা:
- সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্যোগ: বজ্রপাতপ্রবণ এলাকায় মানুষকে সচেতন করা ও সতর্ক থাকার জন্য স্থানীয় প্রশাসন ও গণমাধ্যমকে সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে।
- আবহাওয়ার পূর্বাভাস: বজ্রঝড়ের সম্ভাবনার খবর আগাম জানার চেষ্টা করুন এবং ঝড়ের সময় বাড়ির ভেতরে থাকুন।
এসব নিয়ম মানলে বজ্রপাতের সময় জীবন রক্ষার সম্ভাবনা অনেকাংশে বাড়ানো যায়।